Tuesday, November 20, 2012

দাবা মধ্যভাগের কলাকৌশল - chess middlegame planning

part 9

খেলার মধ্যভাগ

ভূমিকাঃ

আগের লেখায় আমরা খেলার প্রারম্ভিক ভাগ সম্বন্ধে কথা বলেছি। প্রারম্ভিক ভাগ এর শেষে হাতি এবং ঘোড়া সাধারনত প্রাথমিক অবস্থান থেকে বাইরে এসে বোর্ডের মাঝমাঠ দখল এর জন্য তৈরী হয়, রাজা দুর্গ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বোর্ডের এক প্রান্তে নিরাপদ জায়গায় অবস্থান করে, এবং দুই নৌকার মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন হয়। খেলার প্রারম্ভিক ভাগ শেষ হবার পর খেলার মধ্যভাগ শুরু হয়।

এবার আমরা খেলার মধ্যভাগ সম্বন্ধে আলোচনা করবো। মধ্যভাগে সাধারণত বোর্ডের এমন একটা পজিশন তৈরী হয় যেটা আপনি আগে কখনও দেখেননি।  প্রারম্ভিক অবস্থার মতো একদম শুরুতে ঘুটির অবস্থান আপনি জানেন না। তাই কোনো বাধাধরা নিয়ম মেনে খেলা কঠিন। তাই এই অবস্থায় নিজের বিচারবুদ্ধি ই ভরসা। খেলার মধ্যভাগ পরিচালনা করা সবচেয়ে জটিল। মধ্যভাগ কি ভাবে খেলতে সেটা সেখানো বা সহজে বর্ণনা করা খুব কঠিন। তবে বেশ কিছু মৌলিক ব্যাপার শেখানো যেতে পারে। মৌলিক ব্যাপারগুলো জানা থাকলে কোনও অচেনা পরিস্থিতিতে খেলা পরিচালনা করতে সুবিধা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয়গুলো নিচে উদাহরণ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করবো।

মধ্যভাগের পরিকল্পনার রকমভেদঃ 

দাবার ভাষায় খেলার মধ্যভাগের পরিকল্পনা (planning) কে সাধারনত দু ভাগে ভাগ করা হয়ঃ স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা (tactics) ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা (strategy)। তবে অনেক সময় স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা কে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় পরিনত করা সম্ভব, বা উল্টোটাও সম্ভব। এই ব্যাপারগুলো ঠিক কী তা লিখে বোঝানো খুব কঠিন। তাই উদাহরণ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করবো।

স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনাঃ

প্রথমে আমরা স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলবো। স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা বলতে প্রত্যেক এক বা দুই চালে নিজের বা প্রতিপক্ষের তৈরী করা সমস্যা-সম্ভাবনা-সুযোগ-সুবিধা এইসব বোঝানো হয়। দাবায় শিখতে চাইলে অন্য কিছু শেখার আগে tactics শেখা আবশ্যক, কারন আপনি আপনার ঘুটি হারালে খেলায় হার নিশ্চিত। বলা হয় chess is 99 % tactics, এবং এই কথাটা একদম সত্যি। সাধারণ মানের খেলোয়াড়দের মধ্যে সাধারণত একজন অপরের ঘুটি খুব সহজে খেয়ে নিয়ে খেলা জিতে যায়।

অরক্ষিত ঘুটিঃ

যেমন, আপনি যদি আপনার একটা ঘুটি প্রতিপক্ষের দখল আছে এমন একটা অরক্ষিত ঘরে চালেন তাহলে প্রতিপক্ষ পরের চালে সেই ঘুটি খেয়ে নিতে পারে, এবং বাকি খেলার জন্য তার একটা ঘুটি বেশি থাকবে। তাই এরকম ভুল থেকে বিরত থাকলে ভালো। প্রতিপক্ষ আপনাকে বিনামূল্যে একটা ঘুটি খেতে দিলে আপনি খেয়ে নিন, তাহলে আপনার ঘুটি বেশি থাকবে, এবং বাকি খেলায় আপনার জেতার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। আপনি যদি একদম নতুন খেলা শেখেন তাহলে দেখবেন বোর্ডের সমস্ত ঘুটির খেয়াল রাখা বেশ কঠিন। তাই আপনার কোনো ঘুটি অরক্ষিত ঘরে চালার আগে খেয়াল রাখুন যেন প্রতিপক্ষ বিনামূল্যে ঘুটিটি খেয়ে নিতে না পারে। বা বিশেষ প্রয়োজন না হলে কোনো ঘুটি অরক্ষিত ঘরে চালবেন না। সমস্ত ঘুটি একে অপরের দ্বারা সংরক্ষিত রাখুন। এবং প্রতিপক্ষ কখনও তার কোনো ঘুটি অরক্ষিত রাখলে সেই ঘুটি খেয়ে নেবার কোনো উপায় আছে কি না দেখুন। 

লাভজনক বিনিময়ঃ

বিনামূল্যে কোনো কিছু খেতে পেলে সবসময়েই ভালো। কিন্তু প্রতিপক্ষ একটু শক্ত হবার সাথে সাথে আপনাকে বিনামূল্যে কিচু খেতে দেবে না, তাই খাওয়ার অন্য কৌশল শিখতে হবে। নিজের কম মুল্যের ঘুটির বিনিময়ে প্রতিপক্ষের বেশি মূল্যের ঘুটি খাওয়া যায় কি না দেখুন। এতে সব মিলিয়ে আপনার লাভ হবে। যেমন আপনি যদি একটা নৌকার বিনিময়ে প্রতিপক্ষের মন্ত্রী খেয়ে নিতে পারেন তাহলে আপনার লাভ, কারন মন্ত্রীর দাম বেশি, কারন মন্ত্রী ৯, নৌকা ৫।

একই কারনে বোড়ের বদলে অন্য কোনো ঘুটি খাওয়া লাভজনক, বা গজ বা ঘোড়ার বদলে নৌকা বা মন্ত্রী খাওয়া লাভজনক। এমনকি একটা দুইটি হাতি বা একটি ঘোড়া ও একটি হাতির বদলে একটা মন্ত্রী খাওয়া লাভজনক। কারন দুটি হাতি মিলিয়ে মোট ৩ আর ৩ বা ৬, কিন্তু একটা মন্ত্রীর দাম ৯। এরকম কোনো বিনিময়ের সময় হিসাব করে দেখুন বিনিময়ের ফলাফল কি হয়। লাভ করার চেষ্টা করুন, বা যখন লাভ করা সম্ভব নয় তখন লোকসান না করার চেষ্টা করুন। 

এবার পয়েন্ট জেতার আরও কিছু কৌশল শেখাবো।বিপক্ষের ঘুটি বিনামূল্যে বা লাভজনক ভাবে জিতে নেওয়ার জন্য অনেক সময়েই অরক্ষিত ঘুটি কে আক্রমন করা ভালো, কিন্তু বিপক্ষ সাধারণত পরের চালে সহজেই যথাযত রক্ষণের মাধ্যমে আক্রমন প্রতিহত করার সময় পাবে এবং নিজেকে বিপন্মুক্ত করবে। তাহলে পয়েন্ট জেতার উপায় কি? উত্তর নিচের সেকসনে।

দ্বৈত আক্রমণ (double attack): 

একটা দুর্বল লক্ষ্যে আক্রমণ সফল হওয়ার সম্ভাবনা যেহেতু কম, একটার বদলে দুটো লক্ষ্যে একসাথে আক্রমন করার কথা ভাবুন। হ্যা, একমুখী আক্রমন এর চেয়ে দ্বিমুখী আক্রমণ অনেক বেশি কার্যকর। সোজা নিয়ম, তাই তো? নিজের খেলায় এই নিয়ম প্রয়োগ করা কিন্তু এতো সহজ নয়। আসলে প্রচন্ট জটিল পজিশনে বিশাল কঠিন সব চালের পিছনে কোথাও কোনোভাবে দ্বৈত আক্রমণ লুকিয়ে থাকে। কিন্তু সব সময় আক্রমণ এর লক্ষ্যবস্তু খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তাই অভ্যাস এর দরকার। যত অভ্যেস করবেন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু খুঁজে পাওয়া তত সহজ হবে।

দ্বৈত আক্রমণ কেমন হয় নিচে খুব সহজ উদাহরণ দিয়ে দেখাচ্ছি।



উপরের ছবিতে সাদা নৌকা একসাথে দুটো কালো ঘোড়া কে আক্রমণ করেছে, কালো এর মধ্যে একটা ঘুটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পারে, কিন্তু অন্যটা সাদা পরের চালে খেয়ে নিতে পারে। সুতরাং সব মিলিয়ে কালোর একটা ঘোড়া লোকসান হবে। 



দ্বৈত আক্রমণ কে অনেক সময় ফর্ক বলা হয়। ঘোড়ার চাল বাকি ঘুটির থেকে অন্যরকম হওয়ার জন্য ঘোড়া এতে খুব কাজে লাগে। উদাহরণ নিচে। 



উপরের পজিশনে তীর অনুসরণ করে সাদা ঘোড়ার চাল দিয়ে একসাথে রাজা ও মন্ত্রী কে আক্রমণ করতে পারে। আর একটা উদাহরণ



উপরের পজিশনে সাদার ঘোড়া তীর অনুসরণ করে চাল দিয়ে একসাথে কালোর রাজা, মন্ত্রী ও নৌকা কে আক্রমণ করতে পারে। এই রকম ভাবে একটা ঘোড়া দিয়ে দুই এর বেশি বড় ঘুটি আক্রমণ করা কে ফ্যামিলি ফর্ক (family fork) বলে।

লক্ষ্য করে দেখুন, সাদা রঙ্ এর ঘরে থাকা ঘোড়া শুধুমাত্র কালো রঙের ঘরে যেতে পারে, এবং শুধুমাত্র সাদা রঙের ঘর আক্রমণ করতে পারে। তাই দুটো ঘুটি বিপরীত রঙের ঘরে থাকলে ঘোড়া দিয়ে একসাথে আক্রমণ করা সম্ভব নয়। ঘোড়া আক্রমণ এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার খুব সহজ উপায় হলো সব বড় ঘুটি একই রঙের ঘরে আছে কি না খেয়াল রাখা। নিচে আরও কিছু উদাহরণঃ


সাদা ঘোড়া একসাথে কালো রাজা ও নৌকা আক্রমণ করেছে। কালো অবশ্য মন্ত্রী দিয়ে সাদা ঘোড়া খেয়ে নিতে পারে, কিন্তু তাতে লোকসান হবে, কারন মন্ত্রীর দাম অনেক বেশী। ঘোড়া দাম তিন, কিন্তু মন্ত্রীর দাম নয়, আর নৌকার দাম পাঁচ, তাই মন্ত্রী দিয়ে ঘোড়া খাওয়ার বদলে নৌকা খেতে দিলে কম লোকসান হয় ( তিন এর বদলে পাঁচ)। 

নিচে একটু কঠিন উদাহরণ দেওয়া হলো।  



এই অবস্থায় কালোর চাল। দেখে মনে হচ্ছে কালোর মন্ত্রী বিনামূল্যে সাদার গজ খেয়ে নিতে পারে (সবুজ তীর), কিন্তু পরের চালে সাদা ঘোড়া লাল তীর বরাবর চেলে ঘোড়া দিয়ে একসাথে মন্ত্রী ও নৌকা আক্রমণ করবে। এবং পরের চালে মন্ত্রী খেয়ে নেবে। এতে সব মিলিয়ে সাদার লাভ হবে। কারন মন্ত্রীর দাম নয়, আর গজ ও ঘোড়ার সম্মিলিত মূল্য ছয়।

বোড়ে দিয়েও ভালো ফর্ক করা যায় অনেক সময়। উদাহরণ নিচেঃ



উপরের পজিশনে সাদা বোড়ে লাল তীর বরাবর চাল নিয়ে কালোর নৌকা ও ঘোড়া একসাথে আক্রমণ করতে পারে। ঘোড়া ও নৌকা দুজনেই বোড়ের চেয়ে শক্তিশালী হলেও এই আক্রমণের সামনে দুজনেই অসহায়, কারন এদের দুজনের কেউই বোড়ের মতো চলতে পারে না। আর একটা উদাহরণঃ

উপরের ছবিতে সাদা বোড়ের চাল দিয়ে একসাথে গজ ও ঘোড়া আক্রমণ করতে পারে। পরের চালে সাদা দুটো আক্রান্ত ঘুটির মধ্যে মাত্র একটা সরিয়ে নিতে পারে, অন্যটা সাদা খেয়ে নেবে। এক্ষেত্রে  কালো অবশ্য গজ দিয়ে সাদা বোড়ে খেয়ে নিতে পারে। কিন্তু পরের চালে সাদা কালোর গজ খেয়ে নেবে। তাতেও সব মিলিয়ে সাদার লাভ, কারন বোড়ের দাম সবচেয়ে কম। নিচের ছবিতে চালটি বোঝানো হলো।





1 comment: